মঙ্গলকাব্য

মঙ্গলকাব্য

পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল। পৌরাণিক, লৌকিক ও পৌরাণিক-লৌকিক সংমিশ্রিত দেব-দেবীর লীলামাহাত্ম্য, পূজা প্রচার ও ভক্তকাহিনী প্রভৃতি অবলম্বনে রচিত সম্প্রদায়গত প্রচারধর্মী ও আখ্যানমূলক কাব্য হলো মঙ্গলকাব্য। বিভিন্ন দেবদেবীর গুণগান এবং পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনী মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য। তবে 'মঙ্গল' কথাটি থাকলেও 'চৈতন্যমঙ্গল', 'গোবিন্দমঙ্গল' প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত নয়; এগুলো বৈষ্ণব সাহিত্যের অংশ। দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে, প্রায় ৬২ জন কবি মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন।

 

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর

প্র. মঙ্গলকাব্য কী? [১৮তম বিসিএস লিখিত]

উ. বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে বিশেষ এক শ্রেণির ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্যই মঙ্গলকাব্য। এটি রচনার মূল কারণ স্বপ্নদেবী কর্তৃক আদেশ লাভ। 'মঙ্গল' শব্দের অর্থ কল্যাণ। যে কাব্যে দেবতার আরাধনা বা মাহাত্ম্য-কীর্তন করা হয়; যে কাব্য শ্রবণ করলেও মঙ্গল হয় বা ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয় অথবা এক মঙ্গলবার শুরু হতো এবং পরবর্তী মঙ্গলবার শেষ হতো, তাকেই বলা হয় মঙ্গলকাব্য। মূলত, লৌকিক দেব-দেবী নিয়ে রচিত কাব্যই মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্যের মূল উপজীব্য: দেব-দেবীর গুণগান। এতে স্ত্রী দেবতাদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কাব্যগুলোর নামকরণ করা হত যে দেবতার পূজা প্রচারের জন্য কাব্যটি রচিত সে দেবতার নামানুসারে।

প্র. মঙ্গলকাব্যের সাধারণ লক্ষণ/বৈশিষ্ট্যগুলো লিখুন। (৩০/৩৫তম বিসিএস লিখিত)

উ. বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে বিশেষ এক শ্রেণির ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্যই মঙ্গলকাব্য। নিম্নে এর সাধারণ লক্ষণ/বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচিত হলো:

  • প্রায় সব কবি স্বপ্নে দেবতার নির্দেশ পেয়ে কাব্যরচনা করেছেন।
  • প্রথমেই সর্বসিদ্ধিদাতা গণেশের বন্দনা।
  • কাব্যের অধিকাংশ ঘটনা সাধারণ নয়, অসাধারণ।
  • মঙ্গলকাব্যের নায়ক-নায়িকারা সবাই শাপভ্রষ্ট দেবতা, শাপান্তে স্বর্গে ফিরে যান।
  • মর্ত্যে পূজা প্রচারের সময় দেবতাদের আচরণ মানুষের মতো।

প্র. মঙ্গলকাব্য কত প্রকার ও কী কী?

উ. মঙ্গলকাব্য প্রধানত ২ প্রকার। যথা:

  • পৌরাণিক শ্রেণি: 'গৌরীমঙ্গল', 'ভবানীমঙ্গল', 'দুর্গামঙ্গল', 'অন্নদামঙ্গল'।
  • লৌকিক শ্রেণি: 'শিবমঙ্গল', 'মনসামঙ্গল', 'চণ্ডীমঙ্গল', 'সারদামঙ্গল'।

প্র. মঙ্গলকাব্যের প্রধান শাখা কয়টি ও কী কী?

উ. মঙ্গলকাব্যে প্রধান শাখা ৩টি। যথা:

  • মনসামঙ্গল, 
  • চণ্ডীমঙ্গল, 
  • অন্নদামঙ্গল।

প্র. মঙ্গলকাব্যের কয়টি অংশ থাকে?

উ. ৫টি। যথা: 

  • ক. বন্দনা, 
  • খ. আত্মপরিচয় ও গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ, 
  • গ. দেবখণ্ড, 
  • ঘ. মর্ত্যখণ্ড, 
  • ঙ. ফলশ্রুতি।

প্র. আদি মঙ্গলকাব্য কোনটি?

উ. মনসামঙ্গল। এটি মনসা দেবীর কাহিনী নিয়ে রচিত। এর অপর নাম 'পদ্মপুরাণ'।

প্র. মঙ্গলকাব্যে কোন দুই দেবতার প্রাধান্য বেশী?

উ. মনসা ও চণ্ডী।

প্র. মঙ্গলকাব্যের / মনসামঙ্গলের আদি কবি কে?

উ. কানাহরি দত্ত।

প্র. সাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার অপর নাম কী?

উ. কেতকী ও পদ্মাবতী। অস্ট্রিক সমাজের লৌকিক ভয়ভীতি থেকেই এ দেবীর উদ্ভব।

প্র. কোন দেবীকে নিয়ে মনসামঙ্গল রচিত?

উ. সাপের অধিষ্ঠাত্রী মনসা দেবীর কাহিনী নিয়ে মনসামঙ্গল কাব্য রচিত। এ কাব্য মোট ৮ দিনে পরিবেশন করা হতো। শেষ দিনে পরিবেশন করা অংশকে বলা হয় 'অষ্টামঙ্গল'। নিয়তির বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ এ কাব্যকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

প্র. মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্তের পরিচয় দাও। (৩১/১৫তম বিসিএস)

উ. মনসামঙ্গল কাব্যের প্রতিনিধিস্থানীয় ও শ্রেষ্ঠ কবি হলেন বিজয়গুপ্ত। বরিশাল জেলার ফতেহাবাদের ফুল্লশ্রী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে প্রথম সুস্পষ্ট সন-তারিখযুক্ত মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা। 1 তাঁর রচিত মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থের একটি অংশের নাম 'পদ্মপুরাণ'। শ্রাবণ মাসের মনসাপঞ্চমীতে স্বপ্নে দেবীর আদেশ পেয়ে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনামলে ১৪৯৪ সালে তিনি কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হন।  

প্র. 'বাইশা' কী?

উ. মনসামঙ্গলের জনপ্রিয়তার জন্য বিভিন্ন কবির রচিত কাব্য থেকে বিভিন্ন অংশ সংকলিত করে যে পদসংকলন রচনা করা হয়েছিল তাই বাংলা সাহিত্যে বাইশ কবির মনসামঙ্গল বা বাইশা নামে পরিচিত।

প্র. 'বারোমাসী' বা 'বারোমাস্যা' কী?

উ. 'বারোমাসী' বা 'বারোমাস্যা' শব্দের অর্থ পুরো এক বছরের বিবরণ। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের লৌকিক কাহিনী বর্ণনায় নায়ক-নায়িকাদের বারো মাসের সুখ-দুঃখের বিবরণ প্রদানের রীতি দেখা যায়, একেই 'বারোমাসী' বা 'বারোমাস্যা' বলে।

প্র. 'চৌতিশা' কী?

উ. বিপন্ন নায়ক-নায়িকা চৌত্রিশ অক্ষরে ইষ্টদেবতার যে স্তব রচনা করে, তাকে বলে 'চৌতিশা'। ব্যঞ্জনবর্ণ ('ক' থেকে 'হ') পদের আদিতে প্রয়োগ করে 'চৌতিশা' রচিত হতো।

প্র. মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যান্য কবি/ রচয়িতা কে কে?

উ. মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যান্য কবিঃ

নারায়ণ দেব: কিশোরগঞ্জ জেলার বোর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পনের শতকের কবি বলে ধারণা করা হয়। তার রচিত গ্রন্থের নাম 'পদ্মপুরাণ'।

দ্বিজ বংশীদাস: মনসামঙ্গল কাব্য ধারার অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাস বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর পিতা। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার পাতোয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

ক্ষেমানন্দ: এ ধারার অন্যতম জনপ্রিয় কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। কেতকাদাস তার উপাধি। তার কাব্যে মুকুন্দরাম ও রামায়ণের কাহিনীর প্রভাব সুস্পষ্ট।

প্র. মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী আলোচনা কর?

উ. মনসামঙ্গলের কাহিনী: চম্পক নগরের অধীশ্বর বণিক চাঁদ সওদাগর। জগতপিতা শিবের মহাভক্ত। চাঁদ জগতপিতা শিবের থেকে মহাজ্ঞান লাভ করেছেন। মানুষের পূজা ব্যতীত দেবত্ব অর্জন সম্ভব নয়, তাই মনসা চাঁদের কাছে পূজা চাইলেন। শিবভিন্ন অপর কাউকে পূজা করতে চাঁদ প্রত্যাখ্যান করলেন। এমনকি পত্নী সনকার মনসার ঘটে হেঁতালদণ্ড দিয়ে আঘাত করেন। পরিণামে মনসা কৌশলে চাঁদের মহাজ্ঞান হরণ করেন এবং ছয়পুত্রকে বিষ দিয়ে হত্যা করেন। তারপর সমুদ্রপথে চাঁদের বাণিজ্যতরী সপ্তডিঙা মধুকর ডুবিয়ে চাঁদকে সর্বস্বান্ত করেন। চাঁদ কোনোক্রমে প্রাণরক্ষা করেন। মনসা ছলনা করে স্বর্গের নর্তকদম্পতি অনিরুদ্ধ-উষাকে মর্ত্যে পাঠালেন। অনিরুদ্ধ চাঁদের ঘরে জন্ম নেয় লখিন্দর রূপে, আর উজানী শহরে সাধুবণিকের ঘরে বেহুলারূপে উষা জন্ম নেয়। 

বহুকাল পরে সহায় সম্বলহীন চাঁদ চম্পক নগরে পাগল বেশে আসে। অবশেষে পিতা পুত্রের মিলন ঘটল। বেহুলার সাথে লখিন্দরের বিবাহ স্থির হল। মনসা বৃদ্ধা বেশে এসে ছল করে বেহুলাকে শাপ দিল, 'বিভা রাতে খাইবা ভাতার'। সাতালি পর্বতে লোহার বাসরঘর বানানো হল। ছিদ্র পথে কালনাগিনী ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করল। বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে কলার ভেলায় ভেসে পাড়ি দিল। বহু বিপদ অতিক্রম করে অবশেষে নেতো ধোবানির সাহায্যে দেবপুরে পৌঁছে নাচের মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করল। তখন দেবতাদের আদেশে মনসা সব ফিরিয়ে দিল। বেঁচে উঠলো লখিন্দর, ভেসে উঠলো চৌদ্দ ডিঙা। চাঁদ পাগলের মত ছুটে আসলো বেহুলার কাছে। এসে শুনলো যে তাকে মনসার পূজা করতে হবে। কিন্তু এ শর্ত চাঁদ প্রত্যাখান করলো। বেহুলা গিয়ে কেঁদে পড়ল চাঁদের পায়ে এবং চাঁদ বেহুলার অশ্রুর কাছে পরাজিত হল। চাঁদ হেলাভরে মুখ ফিরিয়ে বাঁ হাতে একটি ফুল ছুড়ে দিল। মনসা এতেই খুশি। মর্ত্যবাসের মেয়াদ ফুরালে বেহুলা-লখিন্দর আবার ইন্দ্রসভায় স্থান পেল। আর পৃথিবীতে প্রচারিত হলো মনসার পূজা।

প্র. চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি কে?

উ. মানিক দত্ত।

প্র. চণ্ডীমঙ্গলের প্রধান কবি কে? (১৭তম বিসিএস লিখিত)

উ. মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। তিনি ষোল শতকের কবি ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যের নাম 'শ্রী শ্রী চন্ডীমঙ্গল'। তাঁকে দুঃখ বর্ণনার কবি হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁর রচনার স্বীকৃতিস্বরূপ জমিদার রঘুনাথ রায় 'কবিকঙ্কন' উপাধি প্রদান করেন। মুকুন্দরামের জনপ্রিয় কাহিনীকাব্য 'কালকেতু উপাখ্যান'।

প্র. কোন কাহিনী অবলম্বনে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচিত?

উ. চণ্ডীদেবীর কাহিনী। এটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথমটি আখেটিক বা ব্যাধ কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনী এবং দ্বিতীয়টি বণিক বা ধনপতি সওদাগরের কাহিনী।

প্র. চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কোন কবিকে 'স্বভাব কবি' বলা হয়?

উ. চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দ্বিজ মাধবকে 'স্বভাব কবি' বলা হয়। তাঁর রচিত কাব্যের নাম 'সারদামঙ্গল' (১৫৭৯)।

প্র. চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের 'কালকেতু-ফুল্লরা' খণ্ডের কাহিনী আলোচনা কর।

উ.  চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের 'কালকেতু-ফুল্লরা' খণ্ডের কাহিনী আলোচনা করা হলোঃ

কালকেতু-ফুল্লরার কাহিনী: দেবীর অনুরোধে শিব তার ভক্ত নীলাম্বরকে শাপ দিয়ে মর্ত্যলোকে পাঠান। নীলাম্বর কালকেতু হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কালকেতুর যৌবনপ্রাপ্তির পর তার পিতা ধর্মকেতু ফুল্লরার সাথে বিবাহ দেন। ব্যাধ কালকেতুর অতি দরিদ্র কিন্তু সুখী সংসার। এদিকে কালকেতুর শিকারে প্রায় নির্মূল কলিঙ্গের বনের পশুদের আবেদনে কাতর হয়ে দেবী স্বর্ণগোধিকা রূপে কালকেতুর শিকারে যাবার পথে প্রকট রূপ ধারণ করেন। কালকেতু শিকারে যাবার সময় অমঙ্গলজনক গোধিকা দেখার পর কোন শিকার না পেয়ে ক্রুব্ধ হয়ে গোধিকাটিকে ধনুকের ছিলায় বেঁধে ঘরে নিয়ে আসেন। কালকেতু গোধিকাকে ঘরে বেঁধে পত্নীর উদ্দেশ্যে হাটে রওনা হন। হাটে ফুল্লরার সাথে দেখা হলে তাকে গোধিকার ছাল ছাড়িয়ে শিক পোড়া করতে নির্দেশ দেন। 

ফুল্লরা ঘরে ফিরলে, দেবী এক সুন্দরী যুবতীর রূপে ফুল্লরাকে দেখা দিলেন। ফুল্লরার প্রশ্নের উত্তরে দেবী জানালেন যে, তার স্বামী ব্যাধ কালকেতু তাকে এখানে এনেছেন এবং তিনি এ গৃহেই কিছুদিন বসবাস করতে চান। দেবীকে তাড়াতে ফুল্লরা নিজের বারমাসের দুঃখ কাহিনী বিবৃত করলেন, তবুও দেবী অটল। শেষ পর্যন্ত ফুল্লরা ছুটলেন হাটে, স্বামীর সন্ধানে। উভয়ে গৃহে ফেরার পর দেবীর অনুগ্রহে কালকেতু ধনী হয়ে পশু শিকার ত্যাগ করলেন। বনের পশুরাও নিশ্চিন্তে বসবাস করতে লাগল। দেবীর আশীর্বাদে ধনলাভ করে কালকেতু বন কেটে গুজরাট নগর পত্তন করেন। গুজরাট নগরে নবাগতদের মধ্যে ভাঁড়ুদত্ত নামে ছিল এক প্রতারক। প্রথমে কালকেতু তাকে বিশ্বাস করলেও প্রজাদের প্রতি অত্যাচার করায় তাকে তাড়িয়ে দেন। ভাঁড়ুদত্ত কলিঙ্গের রাজার কাছে গিয়ে তাকে কালকেতুর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে। কলিঙ্গের সেনাপতি গুজরাট আক্রমণ করে কালকেতুকে বন্দী করেন। কিন্তু দেবীর কৃপায় কালকেতু মুক্তি পান এবং কাল পূর্ণ হলে ফুল্লরাসহ স্বর্গে ফিরে যান।  

প্র. অন্নদামঙ্গল ধারার প্রধান কবি কে?

উ. ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (১৭১২-১৭৬০)। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাগরিক কবি এবং মঙ্গলযুগের শেষ কবি। তিনি নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে 'অন্নদামঙ্গল' (১৭৫২-৫৩) কাব্য রচনা করেন। 'সত্য পীরের পাঁচালী' (১৭৩৭-৩৮) তাঁর রচিত অন্যতম গ্রন্থ। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সমাপ্তি ঘটে। 'রায়গুণাকর' ভারতচন্দ্রের উপাধি।

প্র. অন্নদামঙ্গল কাব্য কয়ভাগে বিভক্ত ও কার বন্দনা আছে?

উ. ৩টি খণ্ড। যথা:

  • শিবনারায়ণ অন্নদামঙ্গল,
  • বিদ্যাসুন্দর কালিকামঙ্গল,
  • মানসিংহ-ভবানন্দ অন্নদামঙ্গল। 

এ তিনটি খণ্ডেই দেবী অন্নদার বন্দনা আছে।।

প্র. ধর্মমঙ্গল কাব্যে কার জয়গান ধ্বনিত হয়েছে?

উ. ধর্মঠাকুরের। ধর্মঠাকুর নামে কোনো এক পুরুষ দেবতার পূজা হিন্দু সমাজের নিচু স্তরের লোকদের বিশেষত ডোম সমাজে প্রচলিত ছিলো। ধর্মঠাকুর প্রধানত দাতা, নিঃসন্তান নারীকে সন্তান দান করেন, অনাবৃষ্টি হলে ফসল দেন, কুষ্ঠ রোগীকে রোগ থেকে মুক্ত করেন। ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করে যে কাব্যধারা রচিত হয় তাই ধর্মমঙ্গল কাব্য।  

প্র. ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি কে?

উ. ময়ূরভট্ট। তাঁর রচিত কাব্যের নাম 'হাকন্দপুরাণ'। এ কাব্যের আরও দুজন প্রখ্যাত কবি হলেন- রূপরাম চক্রবর্তী ও ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম চক্রবর্তী অষ্টাদশ শতকের মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠকবি। তাঁর রচিত কাব্যের নাম 'শ্রী ধর্মমঙ্গল'।  

প্র. ধর্মমঙ্গল কাব্য কয়টি পালায় বিভক্ত?

উ. দুটি পালা। যথা:

  • রাজা হরিশচন্দ্রের কাহিনী,
  • লাউসেনের কাহিনী।

প্র. কালিকামঙ্গল কাব্যে কার স্তুতি করা হয়েছে?

উ. দেবী কালীর। এ কাব্য 'বিদ্যাসুন্দর' নামেও অভিহিত যা সাবিরিদ খান কর্তৃক রচিত। সাবিরিদ খান কর্তৃক রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ 'রসুল বিজয়'। প্রকৃতপক্ষে এটি মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত নয়। দেবী কালীর মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা এর মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। রাজকুমার 'সুন্দর' ও বীরসিংহের অপরূপা কন্যা 'বিদ্যা'র গুপ্ত প্রণয়কাহিনী এ কাব্যের প্রধান উপজীব্য। এগার শতকের কাশ্মীরের বিখ্যাত সংস্কৃত কবি বিলহন এর কাব্য 'চৌরপঞ্চাশিকা' অবলম্বনে কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচিত।

প্র. কালিকামঙ্গল কাব্যের আদি কবি কে?

উ. কবি কঙ্ক। সাবিরিদ খান ও রামপ্রসাদ সেন এ কাব্যের বিখ্যাত কবি। রামপ্রসাদ সেন শ্যামাসংগীত রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁর উপাধি 'কবিরঞ্জন'।

প্র. শিবমঙ্গল কাব্য সম্পর্কে কি জান?

উ. কৃষিভিত্তিক সমাজ জীবনে বৈদিক দেবতা রুদ্র শিবের রূপ ধারণ করে। বাঙালি হিন্দুদের জীবনে শিব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বাঙালির সুখ-দুঃখ ভরা সংসারের কথা স্থান পেয়েছে শিবমঙ্গল কাব্যে। পৌরাণিক ও লৌকিক উপাদান মিশ্রিত হয়ে শিবমঙ্গল বা শিবায়ন কাব্য রচিত।

  • শিবমঙ্গল কাব্যের প্রথম কবি রামকৃষ্ণ রায়।
  • এ ধারার প্রথম কাব্য দ্বিজ রতিদেব রচিত 'মৃগলুব্ধ' (১৬৭৪)।
  • এ ধারার শ্রেষ্ঠ কাহিনী রচয়িতা রামেশ্বর ভট্টাচার্য। তার রচিত কাব্যের নাম 'শিবকীর্তন'।
  • এ ধারার অন্যান্য কবি- দ্বিজ কালিদাস, দ্বিজ মণিরাম প্রমুখ।

অন্নদামঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত পঙ্ক্তি:

  • → 'মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।'
  • → 'বড়র পিরীতি বালির বাঁধ! ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেকে চাঁদ।'
  • → 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।'
  • → 'হাভাতে যদ্যপি চায় সাগর শুকায়ে যায়।' (চণ্ডীমঙ্গল)
  • → 'নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?'
কাব্যের নামরচয়িতাগণপ্রধান চরিত্র
মনসামঙ্গলকানাহরি দত্ত, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দচাঁদ সওদাগর, বেহুলা (পুত্রবধূ), লখিন্দর (পুত্র), মনসা (সাপের দেবী)
চণ্ডীমঙ্গলমানিক দত্ত, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ মাধব (স্বভাবকবি)ফুল্লরা, কালকেতু, ধনপতি, ভাঁড়ুদত্ত (ষড়যন্ত্রকারী), মুরারি শীল (ঠগ)
অন্নদামঙ্গলভারতচন্দ্র রায়গুণাকরঈশ্বরী পাটনী, হিরামালিনী
ধর্মমঙ্গলময়ূর ভট্ট, রূপরাম চক্রবর্তী, ঘনরাম চক্রবর্তী, শ্যাম পণ্ডিতহরিশচন্দ্র, লাউসেন
Reference: অগ্রদূত বাংলা