দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯–২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫)
১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানরা বিদ্যুৎগতির ব্লিৎসক্লিগ অপারেশন চালিয়ে পোল্যান্ড, নরওয়ে ও ডেনমার্ক দখল করে নেয়। অক্ষশক্তি জার্মানির পক্ষে এবার যোগ দেয় ইতালি, জাপান, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া আর বুলগেরিয়া। আর মিত্রশক্তির পুরোভাগে ছিল রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, চীন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিল।
ব্রিটেন যুদ্ধ (১৯৪০ খ্রি.): ইউরোপে হিটলারের অপ্রতিহত অগ্রগতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেইনের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। উইনস্টন চার্চিল ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। চার্চিল ক্ষমতা গ্রহণের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বলেন, "We shall fight on the beaches"। জার্মান আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল ব্রিটেন। বার বার ব্রিটেন আক্রমণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন হিটলার।
আল আমিন যুদ্ধ: হিটলার ইংরেজদের আফ্রিকায় জব্দ করার ব্যবস্থা করেন। ১৯৪০ সালে ইতালিয়ান ও জার্মান বাহিনী ব্রিটিশ অধিভুক্ত মিশর আক্রমণ করে। দুর্ধর্ষ জার্মান সেনানায়ক মরু শেয়াল (The Desert Fox) খ্যাত ফিল্ড মার্শাল রোমেলের সামনে একের পর এক নাকানিচুবানি খেতে থাকে ব্রিটিশরা। এ সময় ব্রিটিশদের নেতৃত্বে আসেন কুশলী সমরনায়ক মন্টেগোমারি। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এবার দুর্দিন দেখতে শুরু করে জার্মানরা। যুদ্ধের ফল বিপক্ষে যায় অক্ষশক্তির।
ফ্রান্স দখলের ৪৪ দিন: ফরাসিরা ফ্রান্স-জার্মান সীমান্তে তখনকার দিনে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলেছিল। ম্যাজিনো লাইন। জার্মানির দুর্জয় পাঞ্জার ডিভিশন সুকৌশলে এই ম্যাজিনো লাইন অতিক্রম করে সরাসরি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গিয়ে উপস্থিত হলে মাত্র চুয়াল্লিশ দিনের মাথায় পতন ঘটে ফ্রান্সের। এ সময় ফরাসিদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হন শার্লে দ্য গল। গড়ে তোলেন ফ্রান্সের মুক্তি বাহিনী।
জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ: জাপানের মহাদেশীয় নীতি (Japan's Continental Policy) এর প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রতিবেশী দেশ কোরিয়া এবং চীনকে জয় করে পূর্ব এশিয়ায় অধিপত্য বিস্তার করা। দূরপ্রাচ্যের আধিপত্য নিয়ে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ জাপান হাওয়াই দ্বীপের মার্কিন নৌঘাঁটি পাল হারবার আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। পার্ল হারবারে হামলার পরিকল্পনা করেন জাপানের অ্যাডমিরাল (পরবর্তীতে জাপানের সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক) ইসোরোকু ইয়ামামোতো। হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লক্ষাধিক জাপানিজ-আমেরিকানকে বিভিন্ন বন্দীশিবিরে অন্তরীণ করে রাখা হয়।
নরম্যান্ডির ডি ডে ল্যান্ডিং: ১৯৪৪ সালের ৬ জুন ইউরোপের মূল ভূখণ্ড জার্মান দখলমুক্ত করার জন্য মিত্রবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সেনা ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে অবতরণ করে। এই দিনটি D-Day হিসাবে পালিত হয়। এই সুবিশাল সামরিক অভিযানের নেতা ছিলেন মার্কিন সেনাপতি আইজেনহাওয়ার।
জার্মানির আত্মসমর্পণ: ফরাসি ম্যাজিনো লাইনের বিপরীতে জার্মানরা ফ্রান্স-জার্মান সীমান্তে নির্মাণ করেছিল দুর্ভেদ্য 'সিগফ্রিড লাইন' (Seigfried Line)। মিত্রবাহিনীর আক্রমণে 'সিগফ্রিড লাইন' তছনছ হয়ে যায়। বার্লিনের পতন ঘটে। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে 'পালিয়ে যাওয়ার মত কাপুরুষ অ্যাডলফ হিটলার ছিলেন না; তার কাছে “যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই সর্বজনীন”। ৩০ এপ্রিল, ১৯৪৫ বার্লিনের ফুয়েরার বাঙ্কারে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। ৮ মে, ১৯৪৫ জার্মান বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। এই দিনটি VE Day (Victory in Europe Day) হিসাবে উদযাপিত হয়। মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মানির আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন জার্মান জেনারেল আলফ্রেড জোডল।
হিরোশিমা ও নাগাসাকির ট্র্যাজেডি: জার্মানি যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করলেও জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর বাহিনী ছিল নাছোড়বান্দা। তারা সমান তালে লড়ে যাচ্ছিল মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে। এ সময় মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনার নজির স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করে লিটল বয় ও ফ্যাট ম্যান নামের দুটি ধ্বংসাত্মক আণবিক বোমা। এনোলা গে নামের বিমান থেকে টমাস ফেরিবি যখন হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমাটি নিক্ষেপ করে তখন এর ধ্বংসযজ্ঞ দেখে থমকে যায় বিশ্ব মানবতা। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট হেনরি এস ট্রুম্যান আণবিক বোমা নিক্ষেপের এ পাশবিক সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। ৯ আগস্ট সোভিয়েত সরকারও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দুটি আঘাত সইতে না পেরেই ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের কাছ থেকে কুরিল দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয়। সেই থেকে এই দ্বীপপুঞ্জ দু দেশের মধ্যে বিরোধের একটা কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে।