যুদ্ধকালীন কূটনীতি ও বিভিন্ন সম্মেলন
আটলান্টিক সম্মেলন (১৯৪১ খ্রি.): ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আটলান্টিক মহাসাগরে ব্রিটিশ রণতরী প্রিন্স অব ওয়েলস-এ মিলিত হয়ে ৮টি শর্ত বিশিষ্ট শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। অতপর দুই নেতা মিলিতভাবে একটি ঘোষণা দেন যা আটলান্টিক সনদ (Atlantic Charter) নামে খ্যাত। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে আটলান্টিক চার্টারের উল্লিখিত নীতি ও আদর্শকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পরে আরও ২২টি দেশ এতে স্বাক্ষর করলে মোট সংখ্যা ২৬-এ উন্নীত হয়। এই ঘোষণা জাতিসংঘ ঘোষণা (United Nations Declaration) নামেও খ্যাত। কারণ জাতিসংঘ (United Nations) কথাটি এ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র থেকেই নেওয়া হয়েছিল। জাতিসংঘ গঠনের প্রস্তাবক ছিলেন রুজভেল্ট। তিনিই সর্বপ্রথম 'জাতিসংঘ' নামটি ব্যবহার করেন।
তেহরান সম্মেলন (১৯৪৩ খ্রি.): মিত্রবাহিনীর তিন প্রধান (The Big Three) নেতা অর্থাৎ রুজভেল্ট, চার্চিল এবং সোভিয়েত সেক্রেটারি জেনারেল স্ট্যালিন ইরানের তেহরানে এক বৈঠকে মিলিত হন। এটি ছিল বিগ থ্রি নেতৃবৃন্দের প্রথম বৈঠক। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার কাজে রুজভেল্ট স্ট্যালিনের সমর্থন আদায়ের জোর প্রচেষ্টা চালান ।
ইয়াল্টা সম্মেলন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫ খ্রি.): বিগ থ্রি নেতৃবৃন্দ বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রজাতন্ত্র ইউক্রেন এর ক্রিমিয়ার স্বাস্থ্য নিবাস ইয়াল্টায় এক সম্মেলনে মিলিত হন। এখানেই যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর রূপরেখা প্রণয়ন এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পথে ইয়াল্টা সম্মেলনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিচেনা করা হয়। সম্মেলনে জাতিসংঘ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যথা- প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের হাতে। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য থাকবে এবং তাদের অনুমোদন ছাড়া বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। পরবর্তীকালে এটাকে বলা হয়েছে ভেটো শক্তি (Veto Power)। 'ভেটো' (Veto) শব্দের অর্থ আমি মানি না। কোনো প্রস্তাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কোনো স্থায়ী সদস্যদেশ দ্বিমত পোষণ করলে সে প্রস্তাব আর অনুমোদিত হবে না। স্থির হয় যে, কেবলমাত্র অপ্রণালিগত প্রস্তাবে যেমন বিশ্বশান্তি রক্ষা, যুদ্ধ বন্ধ ইত্যাদি প্রশ্নে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করা যাবে।
পটসডম সম্মেলন (১৭ জুলাই ২ আগস্ট, ১৯৪৫ খ্রি.): জার্মানির পটড্রামে এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের শুরুতে স্ট্যালিন, চার্চিল এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্যুম্যান যোগ দেন। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। কিন্তু তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর এই প্রথম হ্যারি এস ট্রুম্যান মার্কিন প্রতিনিধি হিসেবে শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। অন্যদিকে ব্রিটেনে নির্বাচনে জিতে চার্চিলের পরিবর্তে নতুন প্রধানমন্ত্রী এ্যাটলি সম্মেলনের বাকি দিনগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করেন। পটসডম সম্মেলনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। ক্ষতিপূরণ এবং যুদ্ধোত্তর যুগে ইউরোপের দেশগুলোর সরকার কাঠামো (সমাজতান্ত্রিক না গণতান্ত্রিক) প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির তীব্র বাদানুবাদ হয়। ওডার নদী এবং নিস নদীকে জার্মানি ও পোল্যান্ডের সীমানা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে বিভক্ত করা হলে ওডার-নিস লাইন পূর্ব জার্মানি এবং পোল্যান্ডের মধ্যে সীমা হিসেবে স্বীকৃত হয়।