তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)

তিরিশের দশকের প্রতিনিধি স্থানীয় কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোতে রাঢ় অঞ্চলের গ্রামীণ জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মানব চরিত্রের নানান জটিলতা ও নিগূঢ় রহস্য নিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কলেজে পাঠকালে (১৯২১) অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য কারাভোগ করেন।

  • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ২৩ আগস্ট, ১৮৯৮ সালে বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
  • ১৯৫২ সালে তিনি বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং আট বছর বিধানসভা ও ছয় বছর রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন।
  • তিনি 'পদ্মশ্রী' ও 'পদ্মভূষণ' উপাধি লাভ করেন।
  • তিনি ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় মারা যান। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার শোকবার্তা প্রেরণ করে।

 

প্র. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসসমূহ কী কী?

উ. 'চৈতালি ঘূর্ণি' (১৯৩১): এটি তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস।

ধাত্রীদেবতা' (১৯৩৯): এটি প্রথমে 'জমিদারের মেয়ে' নামে 'বঙ্গশ্রী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে শনিবারের চিঠি পত্রিকায় 'ধাত্রীদেবতা' নামে প্রকাশিত হয়। এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশকে কেন্দ্র করে দেশের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের নানা আন্দোলন ও পরিবর্তন এ উপন্যাসের উপজীব্য।

'কালিন্দী' (১৯৪০): নদীর বুকের একটি চরকে কেন্দ্র করে বিবদমান দুই জমিদার পরিবারের দীর্ঘস্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক বিরোধ, শিল্পপতি ও জমিদারের দ্বন্দ্বে জমিদারের পরাজয় এ উপন্যাসের মূল সুর। এ উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

'কবি' (১৯৪২): ডোম সম্প্রদায়ের নিতাই এক যুবকের কবি রূপে প্রতিষ্ঠা এবং দুটি নারীর সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ক উপাখ্যানই এ উপন্যাসের মূল বিষয়। 'এই খেদ আমার মনে, ভালবেসে মিটলোনা সাধ, কুলালোনা এই জীবনে। হায়! জীবন এত ছোট কেনে? এই ভূবনে।' এ উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি। উল্লেখ্য, 'কবি' নামে হুমায়ূন আহমেদও উপন্যাস রচনা করেছেন।

'গণদেবতা' (১৯৪২): প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের গ্রামীণ সমাজে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের সাথে নব্যধনবাদের দ্বন্দ্ব এ উপন্যাসের নির্যাস।

'আরোগ্য নিকেতন' (১৯৫৩): এটি 'সঞ্জীবন ফার্মাসী' শিরোনামে ১৯৫২ সালে শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের নায়ক প্রাচীনপন্থী কবিরাজ জীবনমহাশয় ও নব্যশিক্ষিত ডাক্তার প্রদ্যোতের সাথে আদর্শিক সংঘাত এবং প্রাচীনবিদ্যা ও নবীন শিক্ষার টানাপোড়েন এ উপন্যাসের মূল কাহিনী। এ উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

'যতিভঙ্গ' (১৯৬২): অবাঙালি যুবতী রৌশনকে নিয়ে লেখা আধুনিক নারীর জীবনজিজ্ঞাসা ও মূল্যবোধ, নগরকেন্দ্রিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যা এ উপন্যাসের উপজীব্য।

'অরণ্যবহ্নি' (১৯৬৬): এটি আদিবাসী সাঁওতাল বিদ্রোহের কাহিনী নিয়ে রচিত।

'১৯৭১' (১৯৭২): ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস '১৯৭১'। 'সুতপার তপস্যা' ও 'একটি কালো মেয়ের কথা' নামে দুটি কাহিনীর সংযোগে রচিত '১৯৭১' উপন্যাসটি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। 'একটি কালো মেয়ের কথা' অংশের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজমার মাধ্যমে একাত্তরের হাজার হাজার নারীর চরিত্র পরিস্ফুটিত হয়েছে। এ অংশে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে গ্রামীণ জীবনের চালচিত্র, বাংলাদেশিদের ত্যাগ ও সংগ্রামের অনন্যতা। ১৯৬৫ সালের পর থেকে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে বিস্তৃত গোপন রাজনৈতিক তৎপরতাকে উপজীব্য করে রচনা করেন 'সুতপার তপস্যা' অংশটি।

'জলসাঘর' (১৯৪২), 'পঞ্চগ্রাম' (১৯৪৩), 'অভিযান' (১৯৪৬), 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' (১৯৪৭), 'পঞ্চপুণ্ডলী' (১৯৫৬), 'রাধা' (১৯৫৭), 'সুতপার তপস্যা'।

প্র. 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' উপন্যাসের পরিচয় দাও।

উ. বীরভূমের কাহার সম্প্রদায়ের জীবন, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ, লোককথা নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা' (১৯৪৭)। এ উপন্যাসে আছে এক আদিম মানবিক সংরাগ। অন্যদিকে রয়েছে এ সম্প্রদায়ের আত্মবিরোধ, পরিবর্তন ও বিলুপ্তির কাহিনী, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে প্রাচীন সমাজের সাথে নতুন পরিবর্তমান জগতের সংঘাত। বীরভূম অঞ্চলের বৃহৎ মানবগোষ্ঠী ও তাদের সমাজের সামগ্রিক রূপ এ উপন্যাসে অঙ্কিত হয়েছে সার্থকভাবে। কোপাই নদীর বৃত্তাকার ধরনের বাঁক নারীর গলার অলংকার হাঁসুলীর মতোই। এই বাঁকে বাঁশ-বেতের গভীর জঙ্গলে বাস করে কাহাররা (পালকী বাহক)। চরিত্র: করালি, বনোয়ারী।

প্র. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ত্রয়ী উপন্যাস কী কী?

উ. 'ধাত্রীদেবতা' (১৯৩৯), 'গণদেবতা' (১৯৪২), 'পঞ্চগ্রাম' (১৯৪৩)।

প্র. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পসমূহ কী কী?

উ. 'রসকলি' (১৯২৮): এটি তাঁর রচিত প্রথম ছোটগল্প যা ১৯২৮ সালে 'কল্লোল' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

'জলসাঘর' (১৯৩৭): এটি ১১টি গল্পের সংকলন।

'বেদেনী' (১৯৪০), 'পাষাণপুরী', 'তারিণী মাঝি', 'নীলকণ্ঠ', 'ছলনাময়ী', 'ডাক হরকরা', 'বেদে', 'পটুয়া', 'মালাকার', 'লাঠিয়াল', 'চৌকিদার', 'অগ্রদানী'।

প্র. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান্য সাহিত্যকর্মসমূহ কী কী?

উ. নাটক: 'পথের ডাক' (১৯৪৩), 'দুই পুরুষ' (১৯৪৩), 'দীপান্তর' (১৯৪৫)।

প্রহসন: চকমকি (১৯৪৫)।

কাব্যগ্রন্থ: 'ত্রিপত্র' (১৯২৬), এর মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য সাধনার হাতেখড়ি।

ভ্রমণকাহিনী: 'মস্কোতে কয়েক দিন' (১৯৫৯)।

Reference: অগ্রদূত বাংলা