তিরিশের দশকের তথাকথিত জনবিচ্ছিন্ন, রবীন্দ্র বলয় ছিন্নকারী ও উত্তরকালের কবিদের উপর সর্বাপেক্ষা প্রভাববিস্তারকারী কবি জীবনানন্দ দাশগুপ্ত। তাঁর রচনায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় প্রকৃতি কাব্যময় হয়ে উঠেছে। আধুনিক নাগরিক জীবনের হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ ও সংশয়ের চিত্র তাঁর কবিতায় দীপ্যমান। বিশ শতকের ষাটের দশকের বাঙালির জাতিসত্ত্বা আন্দোলনে ও ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নিসর্গবিষয়ক কবিতা এদেশের সংগ্রামী জনতাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
প্র. জীবনানন্দ দাশের ওপর কে গবেষণা করেন?
উ. ক্লিনটন বি. সিলি।
প্র. জীবনানন্দ দাশকে কোন ধরনের কবি বলা হয়?
উ. রূপসী বাংলার কবি, ধূসরতার কবি, তিমির হননের কবি, নির্জনতার কবি, চিত্ররূপময় কবি (রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র কবিতা পাঠ করে বলেছেন 'চিত্ররূপময় কবিতা'; বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দকে 'নির্জনতম কবি' এবং অন্নদাশঙ্কর রায় 'শুদ্ধতম কবি' বলে আখ্যায়িত করেন)।
প্র. জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থগুলো কী কী?/২২/২০তম বিসিএস লিখিত)
উ. 'ঝরাপালক' (১৯২৭; বাংলা: ১৩৩৪): এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্য। এ কাব্য রচনায় তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে অনুকরণ করেছেন। এ কাব্যের মাধ্যমে নামের শেষে 'দাশগুপ্ত' এর পরিবর্তে 'দাশ' ব্যবহার করেন। এ কাব্যগ্রন্থে মোট ৩৫টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত আছে।
'ধূসর পাণ্ডুলিপি' (১৯৩৬): এ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা 'মৃত্যুর আগে'। এটি বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' সাহিত্য পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ছাপা হয়। এ কবিতাটি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেব বসুকে লেখা এক চিঠিতে 'চিত্ররূপময়' বলে মন্তব্য করেন। কবিতাটির সাথে W. B Yeats এর The Falling of the Leaves's কবিতার মিল আছে।
'বনলতা সেন' (১৯৪২): ৩০টি কবিতার সমন্বয়ে রচিত এ কাব্য। ভারতীয় পুরাণের অন্তর্ভুক্ত বিষয় যেমন বিদিশা, শ্রাবস্তী উঠে এসেছে, তেমনি বেতের ফলের মতো বা পাখির নীড়ের মতো চোখ ইত্যাদি উপমাগুলোর সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এ কাব্যে। প্রেম ও প্রকৃতি, খণ্ড জীবন ও হতাশা, ক্লান্তি ও অবসাদ, ইতিহাসের বিশাল অনুভূতি ও বর্তমানের ছিন্নভিন্ন অস্তিত্ব, সব কিছুর সমাহার ঘটিয়েছেন তিনি এ কাব্যে। এ কাব্যের 'বনলতা সেন' কবিতাটি তিনি এডগার এলেন পোর 'টু হেলেন' কবিতার অনুকরণে রচনা করেন।
'রূপসী বাংলা' (১৯৫৭): কবির মৃত্যুর পর এ কাব্যের পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়। তিনি এর প্রচ্ছদে নাম রেখেছিলেন 'বাংলার ত্রস্ত নীলিমা'। কিন্তু প্রকাশের 1 সময় এর নামকরণ করা হয় 'রূপসী বাংলা'। এ কাব্যের বিষয় বাংলার গ্রাম, প্রকৃতি, নদী-নালা, পশু-পাখি, উৎসব ও অনুষ্ঠান। এটি তাঁর স্বদেশপ্রীতি ও নিসর্গময়তার পরিচায়ক কাব্য। 'আবার আসব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এ বাংলায়' এ কাব্যের বিখ্যাত পক্তি।
'মহাপৃথিবী' (১৯৪৪), 'সাতটি তারার তিমির' (১৯৪৮), 'বেলা অবেলা কালবেলা' (১৯৬১)।
প্র. জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রতিফলিত চিত্ররূপময়তার পরিচয় দাও।/৩১তম বিসিএস লিখিত।
উ. তিরিশের দশকের আধুনিক কবিদের মধ্যে অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে চিত্ররূপময়তা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা পাঠ করে বলেছেন 'চিত্ররূপময় কবিতা'। রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ দাশকে দেয়া চিঠিতে বলেছেন, 'তোমার কবিতাগুলো পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে'। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ছবির পর ছবি দেখা যায়। এই ছবি কোনো সাদা-কালো ছবি নয়, যেন রঙিন চলচ্চিত্র। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে ইম্প্রেশনিস্টদের কথা মনে পড়ে। যেমন- "চারিপাশে বনের বিস্ময় / চৈত্রের বাতাস / জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন।" এই উদ্ধৃতি পাঠ করলেই চোখে ভেসে উঠে একটি রঙিন ছবি। তাই জীবনানন্দ দাশকে চিত্ররূপময় কবি বলা হয়।
প্র. জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসসমূহ কী কী?
উ. 'মাল্যবান' (১৯৭৩): উপন্যাসটি কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় । দাম্পত্য জীবনের নিষ্ঠুর কাহিনী, সম্পর্কের জটিলতা,পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতাবোধের এক নিষ্ঠুর উপাখ্যানকে ঘিরে এ উপন্যাস রচিত।
'সতীর্থ' (১৯৭৪), 'কল্যাণী' (১৯৯৯)। (সবকটি উপন্যাস কবির মৃত্যুর পর প্রকাশিত)
প্র. জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ কোনটি?
উ. 'কবিতার কথা' (১৯৫৫): এ প্রবন্ধের বিখ্যাত উক্তি- 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।'