বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক শওকত ওসমানের সাহিত্যকর্মে তাঁর তীক্ষ্ণ সমাজসচেতন ও প্রগতিশীল ভাবধারার শৈল্পিক ফসল। মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে তিনি ছিলেন উচ্চকিত কণ্ঠের অধিকারী। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তিনি স্বেচ্ছায় ৫ বছর কলকাতায় নির্বাসনে ছিলেন। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
প্র. শওকত ওসমানের গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ কোনটি?
উ. 'জননী' (১৯৫৮): এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস। সন্তানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য একজন মা গোপনে যে কোনো পথ অবলম্বন করতে পারেন, শওকত ওসমান সে কথাই এ উপন্যাসে ব্যক্ত করেছেন। মহেশডাঙ্গার দরিয়াবিবি সন্তান মোনাদি'কে আর্থিক সহায়তা দেয়ার জন্য ইয়াকুবের শয্যাসঙ্গিনী হয়। ইয়াকুবের ঔরষে তার গর্ভে সন্তান এলেও সামাজিক সকল বিপত্তি এড়িয়ে অসীম মমতায় তাকে লালন-পালন করে। এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে মুসলিম সমাজের শরিয়তি দ্বন্দ্ব, বিত্তবানদের স্বার্থপরতা, গ্রামের দরিদ্র মানুষদের পারস্পরিক বিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। ওসমান জামাল এটি ইংরেজিতে 'জননী' (১৯৯৩) নামেই অনুবাদ করে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশ করেন। চরিত্র: দরিয়া বিবি, আজহার, মোনাদি, ইয়াকুব, চন্দ্রকোটাল।
প্র. তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসসমূহ কী কী? ৪০/৩৩/৩০/২১তম বিসিএস লিখিত।
উ. 'জাহান্নাম হইতে বিদায়' (১৯৭১): 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদক শ্রী সাগরময় ঘোষের অনুরোধে শওকত ওসমান উপন্যাসটি সাতটি পর্বে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে কলকাতায় বসে লেখেন। 'দেশ' পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সময়কার চালচিত্র ফুটে উঠেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র: শিক্ষক গাজী রহমান। ( বাজারে প্রচলিত অনেক বইয়ে 'জাহান্নাম হইতে বিদায়' উপন্যাসটিকে 'জাহান্নাম হতে বিদায়' বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটির সঠিক নাম 'জাহান্নাম হইতে বিদায়'। সূত্র: বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান এবং মূল গ্রন্থা )
'দুই সৈনিক' (১৯৭৩), 'নেকড়ে অরণ্য' (১৯৭৩), 'জলাঙ্গী' (১৯৭৬)।
প্র. তাঁর অন্যান্য উপন্যাসসমূহ কী কী?
উ. 'বনি আদম': এটি ১৯৪৬ সালে দৈনিক আজাদের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়।
'ক্রীতদাসের হাসি' (১৯৬২): এটি তাঁর প্রতীকাশ্রয়ী উপন্যাস। উপন্যাসটি আরব্য রজনী 'আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা' এর শেষ গল্প 'জাহাকুল আবদ' এর অনুবাদ কিন্তু শিশুতোষ: 'ওটেন সাহেবের বাংলো' (১৯৪৪), 'মঙ্কুইটোফোন' সর্বাংশে নয়। এ উপন্যাসে বাগদাদের বাদশা হারুন অর (১৯৫৭), 'ক্ষুদে সোশালিস্ট' (১৯৭৩), 'পঞ্চসঙ্গী' (১৯৮৭)। রশিদের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তানিদের বিরূপ শাসনের সমালোচনা করা হয়েছে। বাগদাদের বাদশা হারুন অর রশিদ অত্যাচারী। সে ক্রীতদাস তাতারি ও বাঁদি মেহেরজানের প্রণয়ে বাঁধা সৃষ্টি এবং তাতারিকে গৃহবন্দী ও অত্যাচার করে। তাতারি আমৃত্যু বাদশা হারুনের নির্যাতনের প্রতিবাদ করে যায়। এখানে তাতারি বাঙালি জনতার এবং বাদশা হারুন আইয়ুব খানের প্রতীক। এর জন্য ১৯৬৬ সালে তিনি 'আদমজী সাহিত্য পুরস্কার' লাভ করেন। কবির চৌধুরী এটি ইংরেজিতে 'এ স্লেভ লাফস' (১৯৭৬) নামে অনুবাদ করে দিল্লি থেকে প্রকাশ করেন।
'আর্তনাদ' (১৯৮৫): ভাষা আন্দোলনভিত্তিক উপন্যাস। চরিত্র: জাফর আলী।
'সমাগম' (১৯৬৭), 'চৌরসন্ধি' (১৯৬৮), 'রাজা উপাখ্যান' (১৯৭১), 'পতঙ্গ পিঞ্জর' (১৯৮৩), 'রাজপুরুষ' (১৯৯২)।
প্র. তাঁর অন্যান্য রচনাবলি কী কী?
নাটক: 'আমলার মামলা' (১৯৪৯), 'কাঁকড়মনি' (১৯৫২), 'তস্কর ও লস্কর' (১৯৫৩), 'বাগদাদের কবি' (১৯৫৩), 'জন্য জন্মান্তর' (১৯৬০), 'পূর্ণ স্বাধীনতা চূর্ণ স্বাধীনতা' (১৯৯০)।
গল্প: 'জন্ম যদি তব বঙ্গে' (১৯৭৫)। এটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক।
'ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী' (১৯৯০): এর জন্য তিনি ১৯৯১ সালে ফিলিপস পুরস্কার পান।
'পিজরাপোল' (১৯৫১), 'জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প'(১৯৫২), 'প্রস্তর ফলক' (১৯৬৪), 'নেত্রপথ' (১৯৬৮), 'মনিব ও তাহার কুকুর' (১৯৮৬), 'পুরাতন খঞ্জর' (১৯৮৭)।
প্রবন্ধ: 'ভাব ভাষা ও ভাবনা' (১৯৭৪), 'সংস্কৃতির চড়াই উৎরাই' (১৯৮৫), 'মুসলিম মানসের রূপান্তর' (১৯৮৬)।
শিশুতোষ: 'ওটেন সাহেবের বাংলো' (১৯৪৪), 'মঙ্কুইটোফোন' (১৯৫৭), 'ক্ষুদে সোশালিস্ট' (১৯৭৩), 'পঞ্চসঙ্গী' (১৯৮৭)।
রম্যরচনা: 'নিজস্ব সংবাদদাতা প্রেরিত' (১৯৮২)।
স্মৃতিকথা: 'স্বজন সংগ্রাম' (১৯৮৬), 'কালরাত্রি খণ্ডচিত্র' (১৯৮৬), 'অনেক কথন' (১৯৯১), 'মুজিবনগর' (১৯৯৩), 'অস্তিত্বের সঙ্গে সংলাপ' (১৯৯৪), 'সোদরের খোঁজে স্বদেশের সন্ধানে' (১৯৯৫), 'মৌলবাদের আগুন নিয়ে খেলা' (১৯৯৬), 'আর এক ধারাভাষ্য' (১৯৯৬)।
অনুবাদ: 'নিশো' (১৯৪৮-৪৯), 'লুকনিতশি' (১৯৪৮) 'বাগদাদের কবি' (১৯৫৩), 'টাইম মেশিন' (১৯৫৯), 'ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা' (১৯৭৩), 'সন্তানের স্বীকারোক্তি' (১৯৮৫)।
প্র. মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক একটি উপন্যাসের মূল্যায়ন করুন? (৩০/৩২/২৯তম বিসিএস লিখিত)
উ. বাংলা সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ অনুষঙ্গটি একে অপরের পরিপূরক। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস রচিত হয়েছে। শওকত ওসমানের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যতম উপন্যাস 'জলাঙ্গী' (১৯৭৬)। এ উপন্যাসে গ্রাম্য এক কৃষক পরিবারের শহরে পড়ুয়া ছাত্র জমিরালীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং তাঁর পরিবারের চালচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। এতে রয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের পাশবিক নিষ্ঠুরতার চিত্র। বৃদ্ধ মা-বাবা, প্রেমিকা হাজেরাকে উপেক্ষা করে দেশের টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের দেয়া আগুনে তার গ্রামের বাড়ি পুড়ে যায়। সেই আগুনেই তার বাবা-মা মারা যায়। হাজেরাকে খুঁজতে গিয়ে মিলিটারির হাতে ধরা পরে এবং মিলিটারি ক্যাম্পে সে হাজেরাকে দেখতে পায়। রাজাকার ও মিলিটারিরা মিলে গ্রামে বিচার করে তাদের মেঘনার বুকে গলায় পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও জমিরালী দেশপ্রেমকে জলাঞ্জলি দেয়নি, তবুও মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে 'জয় বাংলা'।