গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমূহ

প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত ২য় কাব্যগ্রন্থের নাম কী?

উ. 'বনফুল' (১৮৮০): এটি রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম সম্পূর্ণ কাব্য। কিন্তু প্রকাশের দিক দিয়ে দ্বিতীয়। গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হওয়ার ৪ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৫ বছর বয়সে রচনা করেন। এ কাব্যের কবিতাগুলি ১৮৭৬ সালেই 'জ্ঞানাঙ্কুর' ও 'প্রতিবিম্ব' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালে। তাই 'বনফুল'কে প্রথম কাব্যগ্রন্থ বলা যায় না। যদিও অনেকে এটিকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ বলে থাকেন কিন্তু তা সঠিক নয়। এ কাব্যের উল্লেখযোগ্য চরিত্র: বিজয়, কমলা, নীরদ, নীরজা।  (সূত্র: বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান)

প্র. কত সালে ও কোথা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল চুরি হয়ে যায়?

উ. শান্তি নিকেতন থেকে ২৪ মার্চ, ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে।

প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের উল্লেখযোগ্য কবিতা কোনটি?

উ. 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' (আজি এ প্রভাতে রবির কর / কেমনে পশিল প্রাণের 'পর)।

প্র. 'গীতাঞ্জলি' কাব্য কত সালে প্রকাশিত হয়?

উ. ১৯১০ সালে।

প্র.  গীতাঞ্জলির অনুবাদ Song Offerings নামে কত সালে প্রকাশিত হয়?

উ. ১৯১২ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত হয়।

প্র. Song Offerings এর ভূমিকা কে লেখেন?

উ. ইংরেজ কবি (জাতিতে আইরিশ) W.B Yeats.

প্র.  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন গ্রন্থের জন্য কত সালে নোবেল পান? (২৭/২১তম বিসিএস লিখিত)

উ.  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পাননি। তিনি ১৯১৩ সালের নভেম্বর মাসে নোবেল পুরস্কার পান 'গীতাঞ্জলি'র ইংরেজি অনুবাদ Song Offerings এর জন্য। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সময় তাঁর বয়স ছিল ৫২ বছর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় এবং সাহিত্যে একমাত্র নোবেলজয়ী বাঙালি।

প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলোর নাম কী?

উ. রবীন্দ্রনাথের মোট কাব্যগ্রন্থ ৫৬টি।

'কবি-কাহিনী' (১৮৭৮): প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, যা অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। চার সর্গে বিভক্ত এ কাব্যের নায়ক কবি এবং নায়িকা নলিনী। নলিনীর মৃত্যুর পর নায়ক কবির বিশ্বপ্রেমের উপলব্ধিতে কাব্যের সমাপ্তি। ধরে নেয়া হয়, এ কাব্যের নায়ক রবীন্দ্রনাথ নিজেই।

'প্রভাতসঙ্গীত' (১৮৮৩): কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ২১টি কবিতা আছে। উল্লেখযোগ্য কবিতা: নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।

'কড়ি ও কোমল' (১৮৮৬): তারুণ্যের উজ্জ্বলতা, নারীদেহের প্রতি মুগ্ধতা ও মৃত্যুর রহস্যময়তার প্রতি আকর্ষণ এ কাব্যের বৈশিষ্ট্য। ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮৩ সালে রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করলে ১৯ এপ্রিল, ১৮৮৪ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পত্নী প্রায় সমবয়সী বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। রবীন্দ্রমনন ও রবীন্দ্রপ্রতিভার বিকাশে কাদম্বরী দেবীর অসামান্য অবদান রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু ভুলতে পারেননি। বৌদির আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু কবির মনে যে বিরাগের সৃষ্টি করেছিল, তাঁর প্রভাব এ কাব্যগ্রন্থে আছে। উল্লেখযোগ্য কবিতা: চুম্বন, বাহু, চরণ, মোহ।

'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি' (১৮৮৪): অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র সম্পাদিত মধ্যযুগীয় মৈথিলি ভাষায় রচিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ' গ্রন্থের কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টমাস চ্যাটার্টন নামক জনৈক বালক কবির কথা শুনেছিলেন, যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। পরবর্তীতে চ্যাটার্টনের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রজবুলি ভাষায় গীতিকাব্য সংকলন 'ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি' রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একমাত্র পদাবলি সাহিত্যের রচয়িতা। কাব্যটি উৎসর্গ করেন কাদম্বরী দেবীকে। এ গীতিকাব্য সংকলনের বিখ্যাত পড়ক্তি-

মরণরে, 

তুহু মম শ্যাম সমান। 

মেঘ বরণ তুঝ, মেঘ জটাজুট, 

রক্ত কমল কর, রক্ত অধর-পুট, 

তাপ-বিমোচন করুণ কোর তব, 

মৃত্যু অমৃত করে দান। 

তুহু মম শ্যাম সমান।

'সোনার তরী' (১৮৯৪): ১৮৯১ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার জন্য কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে অবস্থান করেন। এ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা পদ্মাবিধৌত পূর্ববঙ্গের পটভূমিতে লেখা, যা তিনি শিলাইদহে বসে রচনা করেন। কাব্যটিতে তিনি তাঁর জীবন ও কীর্তির ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা 'সোনার তরী', যা মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। কাব্যটির অন্যান্য কবিতা 'নিরুদ্দেশ যাত্রা', 'হিং টিং ছট'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যটি কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের প্রতি উৎসর্গ করেন।

'চিত্রা' (১৮৯৬): এ কাব্যের কিছু কবিতায় বাস্তবমুখিতা, কিছু কবিতায় নিরুদ্দেশ সৌন্দর্যের অভিসার- এই দুই ভিন্নমুখী সুর এ কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। উল্লেখযোগ্য কবিতা: দুই বিঘা জমি, উর্বশী, জীবনদেবতা, ১৪০০ সাল, বিজয়িনী, দুঃসময়, স্বর্গ হইতে বিদায় ইত্যাদি।

'কথা ও কাহিনী' (১৯০০): 'কথা' (১৮৯৯) ও 'কাহিনী' (১৮৯৯) নামে পৃথক দুটি কাব্যের একত্রিত রূপ এ কাব্যটি। কাব্যটির অধিকাংশ কবিতার উৎস উইলিয়াম টডের 'রাজস্থান' গ্রন্থের কাহিনী। কবিতা: দেবতার গ্রাস, বিসর্জন, গান্ধারীর আবেদন, পূজারিণী ইত্যাদি।

'ক্ষণিকা' (১৯০০): জীবনের আপাত-তুচ্ছ মুহূর্তগুলির প্রতি গভীর ভালোবাসা, যৌবনের উল্লাস ও চটুলতা এ কাব্যের মূল সুর। উল্লেখযোগ্য কবিতা: ক্ষণিকা, অচেনা, উদাসীন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যটি লোকেন্দ্রনাথ পালিতকে উৎসর্গ করেন।

'স্মরণ' (১৯০৩): স্ত্রীর মৃত্যুকে উপলক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ এটি রচনা করেন। ১৯০২ সালে (৭ অগ্রহায়ণ, ১৩০৯ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মৃত্যুবরণ করেন।

'খেয়া' (১৯০৬): এ কাব্যের ৫৫টি কবিতার মধ্যে ক্লান্তি ও বিষাদের সুর প্রাধান্য পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য কবিতা: পথের শেষ, বিদায়, আগমন, জাগরণ, শেষ খেয়া, দীঘি। এটি জগদীশচন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেন।

'বলাকা' (১৯১৬): ফরাসী দার্শনিক বার্গস-র তত্ত্ব প্রয়োগ করে তিনি এ কাব্যটি রচনা করেন। এ কাব্যে গতিতত্ত্বের প্রকাশ ঘটেছে। এ কাব্যে মোট ৪৫টি কবিতা রয়েছে। বিখ্যাত কবিতা 'সবুজের অভিযান', 'শা-জাহান', 'ছবি', 'শঙ্খ'। এটি তিনি উইলিয়াম পিয়ারসনকে উৎসর্গ করেন।

'পলাতকা' (১৯১৮): রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা মাধুরীলতার অকাল মৃত্যুর (মে, ১৯১৮) চালচিত্র ধারণ করে রচনা করেন এ কাব্যটি। এ কাব্যে নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি আলোচিত হয়েছে।

'পূরবী' (১৯২৫): এটি আর্জেন্টিনার কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পকে উৎসর্গ করেন এবং ভিক্টোরিয়া ওকাম্পকে 'বিজয়া' নামে অভিহিত করেন।

'পুনশ্চ' (১৯৩২): এ কাব্য থেকে তিনি গদ্যরীতিতে কবিতা লেখা শুরু করেন। এ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম কবিতা 'তীর্থযাত্রী' টি.এস এলিয়ট এর 'The journey of the Magi' কবিতার অনূদিত রূপ। এছাড়াও 'বাঁশী' কবিতাটির ভাবও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টি.এস এলিয়টের 'The Love Song of J. Alfred Prufrock' থেকে গ্রহণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য কবিতা: শেষ চিঠি, ক্যামেলিয়া, সাধারণ মেয়ে।

'আকাশ প্রদীপ' (১৯৩৯): এ কাব্যের কবিতায় কবির শৈশবস্মৃতি এবং জীবন সায়াহ্নের অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে। এটি উৎসর্গ করেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে।

'শেষলেখা' (১৯৪১): এটি তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ যা মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।

'স্ফুলিঙ্গ' (১৯৪৫): কবি জীবিতাবস্থায় অনেক ব্যক্তির ডায়েরিতে কয়েকটি লাইন লিখে স্বাক্ষর দিয়েছেন। এই কয়েকটি লাইনই ছিল এক একটি কবিতা। পরবর্তীতে 'স্ফুলিঙ্গ' গ্রন্থটিতে এসব কবিতা সংকলন করা হয়।

'সন্ধ্যা-সংগীত' (১৮৮২), 'মানসী' (১৮৯০), 'চৈতালি' (১৮৯৭), 'কণিকা' (১৮৯৯), 'কল্পনা' (১৯০০), 'নৈবেদ্য' (১৯০১), 'উৎসর্গ' (১৯১৪), 'মহুয়া' (১৯২৯), 'পরিশেষ' (১৯৩২), 'শেষসপ্তক' (১৯৩৫), 'শ্যামলী' (১৯৩৬), 'পত্রপুট' (১৯৩৬), 'সেঁজুতি' (১৯৩৮), 'রোগশয্যায়' (১৯৪০), 'নবজাতক' (১৯৪০), 'আরোগ্য' (১৯৪১), 'জন্মদিনে' (১৯৪১)।

 

প্র. 'মানসী' কাব্যগ্রন্থের পরিচয় দাও।

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিণত কাব্যকলার অন্যতম প্রতিফলন 'মানসী' (১৮৯০)। এ কাব্যে বিশাল প্রকৃতির প্রভাব কবির আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনায়, মেধা-মননে ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল। কবি নিজেই বলেছেন, 'নূতন আবেষ্টনে এই কবিতাগুলি সহসা যেন নবদেহ ধারণ করল।' 'মানসী' কাব্যে কবির সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল। এ কাব্যের কবিতায় একদিকে যেমন রয়েছে অতীত জীবনের পিছুটান আবার অপরদিকে রয়েছে নবযৌবনের কর্ম- উদ্দীপনার প্রখর দীপ্তি। তাই বুদ্ধদেব বসু 'মানসী' কাব্যকে রবীন্দ্র-কাব্যের অণুবিশ্ব বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাজীপুরে অবস্থানকালীন সময়ে এ কবিতাগুলো লেখেন। এ কাব্যের উল্লেখযোগ্য কবিতা: 'ব্যক্ত প্রেম', 'গুপ্ত প্রেম', 'নিষ্ফল উপহার', 'দুরন্ত আশা', 'কুহুধ্বনি', 'মেঘদূত', 'অহল্যার প্রতি', 'ক্ষণিক মিলন', 'বিচ্ছেদের শাস্তি', 'অপেক্ষা', 'আত্মসমর্পণ' ইত্যাদি।

প্র. 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের পরিচয় দাও।

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭টি গানের সংকলন 'গীতাঞ্জলি' (১৯১০) কাব্য। এ কাব্যের গানগুলি ১৯০৮-১৯০৯ সালের মধ্যে রচিত এবং গ্রন্থাকারে ১৯১০ সালে প্রকাশিত। এ গানগুলো মূলত কবিতা এবং সহজ ও সরল ভাষায়, সাবলীল ছন্দে রচিত। এ গান জাতীয় কবিতাগুলোতে ফুটে উঠেছে ঈশ্বরকে না পাওয়ার বেদনা, আত্ম-অহংকার বিসর্জন দিয়ে সহনশীলতা প্রদর্শন, ঈশ্বরের ক্ষণদর্শনানুভূতি, দীন-হীনদের মাঝে ঈশ্বর কল্পনা, অসীম-সসীমের লীলাতত্ত্ব ইত্যাদি। এর মূলসুর ঈশ্বরকেন্দ্রিক হলেও তা কোনো বিশেষ বাক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। এটি বিশাল প্রকৃতির সৌন্দর্য থেকে উৎসারিত অধ্যাত্মবোধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। গীতাঞ্জলির ১৫৭টি গানের মধ্য থেকে ৫৩টি, 'গীতিমাল্য' ১৬টি, 'নৈবেদ্য' ১৫টি, 'খেয়া' ১১টি, 'শিশু' ৩টি, 'কল্পনা' ১টি, 'উৎসর্গ' ১টি, 'স্মরণ' ১টি, 'চৈতালী' ১টি এবং 'অচলায়তন' থেকে ১টিসহ মোট ৯টি গ্রন্থের ১০৩টি গান/কবিতার ইংরেজি অনুবাদ Song Offerings নামে নভেম্বর, ১৯১২ সালে ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। 1 Song Offerings এর ভূমিকা লিখেন ইংরেজ কবি W.B Yeats. 'গীতাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থের কিছু গানের ইংরেজি অনুবাদ করে দেন ব্রিটিশ লেখক ও অনুবাদক ব্রাদার জেমস ও জো উইন্টার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ Song Offerings এর জন্য নোবেল পান।  

প্র. 'শেষ লেখা' কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে লিখ।

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ কাব্য 'শেষ লেখা' (১৯৪১)। এটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়, তাই তিনি এটির নামকরণ করে যেতে পারেননি। এ গ্রন্থের কবিতাগুলো তাঁর জীবনের শেষ সময়কালের লেখা এবং কয়েকটি কবিতা মুখে মুখে রচিত। 'তোমার সৃষ্টির পথ', 'দুখের আধার রাত্রি' প্রভৃতি কবিতায় রয়েছে জীবন সম্বন্ধে দার্শনিক গভীর অনুভূতির প্রকাশ অপরদিকে, অন্যান্য কবিতায় ভাববাদী দর্শনের মধ্যেও ইহজগৎ প্রীতি গভীরভাবে প্রকাশিত। যেমনঃ

রূপনারানের কূলে/ জেগে উঠিলাম;

 জানিলাম এ জগৎ/ স্বপ্ন নয়'।

প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রধান উপন্যাসগুলোর নাম কী?

'করুণা': এটি তাঁর প্রথম লেখা অসমাপ্ত উপন্যাস। এটি মাসিক 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত 'রবীন্দ্র রচনাবলি'তে (১৯৬১) প্রথম 'করুণা' প্রকাশিত হয়। ২৭টি পরিচ্ছেদে এ উপন্যাসটি রচিত। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: মহেন্দ্র, মোহিনী, রজনী। অনেকের মতে, এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস। যেহেতু এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি, সুতরাং এটি প্রথম উপন্যাস- এ দাবিটি হাস্যকর ও অযৌক্তিক। 

'রাজর্ষি (১৮৮৭)। ত্রিপুরার রাজপরিবারের ইতিহাস নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস। উপন্যাসটি 'বালক' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের প্রথমাংশ নিয়ে 'বিসর্জন' (১৮৯০) নাটক রচিত হয়। 

'নৌকাডুবি' (১৯০৬): এটি সামাজিক উপন্যাস, যা 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

'প্রজাপতির নির্বন্ধ' (১৯০৮)। এটি হাস্যরসাত্মক উপন্যাস। পরবর্তীতে এর নাট্যরূপ প্রহসন 'চিরকুমার সভা'। 

'ঘরে-বাইরে' (১৯১৬): চলিত ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস, যা 'সবুজপত্র' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর মূল সুর। এ উপন্যাসের নায়িকা বিমলা স্বামী নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও বিপ্লবী সন্দীপের দ্বারা আকর্ষিত। একদিকে বাইরের আন্দোলনের উত্তেজনা অন্যদিকে তিনটি মানুষের জীবনে টানাপোড়েন ও ব্যক্তিগত জীবনের দ্বন্দ্ব, এই দুই মিলে 'ঘরে-বাইরে' উপন্যাস। উল্লেখযোগ্য চরিত্র। নিখিলেশ (রাজবংশীয় যুবক অতিমাত্রায় শুদ্ধাচারী), বিমলা (সাধারণ পরিবারের মেয়ে), সন্দীপ (স্বদেশী আন্দোলনের নেতা)। 

'চতুরঙ্গ' (১৯১৬); সাধু ভাষায় রচিত রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ উপন্যাস। 

'যোগাযোগ' (১৯২৯): সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। মাসিক 'বিচিত্রা' পত্রিকায় প্রকাশকালে এর নাম ছিল 'তিন পুরুষ'। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় এর নামকরণ হয় 'যোগাযোগ'। নায়িকা কুমুদিনী ও নায়ক মধুসুদনের ব্যক্তিত্বের তীব্র বিরোধ এ উপন্যাসের কেন্দ্র। শেষে স্বামীর কাছে কুমুদিনীর দ্বিধান্বিত সমর্পণ। চরিত্র। মধুসূদন, কুমুদিনী। 

'দুইবোন' (১৯৩৩): উপন্যাসটি ১৯৩২-১৯৩৩ সাল পর্যন্ত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। বড় বোন শর্মিলার স্বামী শশাঙ্কের সাথে ছোট বোন উর্মিলার ঘনিষ্ঠতা তাদের জীবনে যে আলোড়ন তুলেছিল, তারই নাটকীয়তার রূপায়ণ এ উপন্যাস। চরিত্র: শর্মিলা, উর্মিলা, শশাঙ্ক। 

'চার অধ্যায়' (১৯৩৪): অসহযোগ আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলায় নতুন করে যে হিংসাত্মক বিপ্লব প্রচেষ্টা গড়ে উঠেছিল, তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব ফুটে উঠেছে এ উপন্যাসে। সন্ত্রাসবাদের সমালোচনা করে এ উপন্যাসের কাহিনী রচিত। চরিত্র: অতিন, এলা, ইন্দ্রনাথ।

'মালঞ্চ' (১৯৩৪): মৃত্যুপথযাত্রী নারী নীরজা ও তাঁর স্বামী আদিত্যকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কাহিনী রচিত। উল্লেখযোগ্য চরিত্র: নীরজা, আদিত্য, সরলা।

প্র. 'বৌঠাকুরানীর হাট' উপন্যাসের পরিচয় দাও।

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ঐতিহাসিক উপন্যাস 'বৌঠাকুরানীর হাট' (১৮৮৩)। এ উপন্যাসের কাহিনী রবীন্দ্রনাথ প্রতাপচন্দ্র ঘোষের 'বঙ্গাধিপতি পরাজয়' (১৯৬৯) থেকে সংগ্রহ করেন। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথ মাতৃবিয়োগের পর বড় বোন সৌদামিনী দেবীর স্নেহে লালিত-পালিত হন। এ সময়কাল সম্পর্কিত কিছু কাহিনী এবং কয়েকটি ঐতিহাসিক চরিত্রের সম্মিলনে তিনি এটি রচনা করেন। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও বাকলার জমিদার রামচন্দ্রের বিবাদকে উপজীব্য করে রচনা করেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিকতার ছোঁয়া থাকলেও এসবের সঙ্গে ইতিহাসের সরাসরি কোন সম্পর্ক নাই। চরিত্র: বসন্ত রায়, উদয়াদিত্য, রামচন্দ্র। পরবর্তীতে তিনি এর কাহিনী অবলম্বনে 'প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০৯) নাটকটি রচনা করেন।

প্র. 'চোখের বালি' উপন্যাসের পরিচয় দাও।

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস 'চোখের বালি' (১৯০৩)। এটি ৫৫টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত। এ উপন্যাসটি প্রথমে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সমাজ ও যুগযুগান্তরের সংস্কারের সাথে ব্যক্তিজীবনের বিরোধ এ উপন্যাসের মূল সুর। বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রের বিয়ে হওয়ার কথা থাকলেও মহেন্দ্রের অনাগ্রহের কারণে অন্যত্র বিয়ে হয় এবং কিছু দিনের মধ্যে বিনোদিনী বিধবা হয়। শিক্ষিত, মার্জিত বিনোদিনী ঘটনাচক্রে মহেন্দ্রের বাড়িতে আসলে তাকে দেখে মহেন্দ্র মুগ্ধ হয় এবং উপলব্ধি করে সমচেতনা সম্পন্ন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা। সুন্দরী ও কর্মদক্ষ বিনোদিনী তিলে তিলে মহেন্দ্রকে ঘোরায় চড়কির মত। তবে বিনোদিনী সমর্পিত হতে চায় বিহারীর নিকট। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিধবা বিনোদিনীকে জীবনের সকল কোলাহল এড়িয়ে, সামাজিক ও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রাধান্য দিয়ে কাশীর নির্লিপ্ত জীবনে নিক্ষেপ করেন। চরিত্র: আশালতা, মহেন্দ্র, বিনোদিনী, বিহারী, রাজলক্ষ্মী, অন্নপূর্ণা।

প্র. 'গোরা' উপন্যাস সম্পর্কে কি জান?

উ. উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগের ধর্মান্দোলন, স্বদেশপ্রেম ও নারীমুক্তি চিন্তার পটভূমিকা তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেন বিখ্যাত রাজনৈতিক উপন্যাস 'গোরা' (১৯১০)। এটি ১৯০৮-১৯১০ পর্যন্ত 'প্রবাসী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের নায়ক গোরা সিপাহী বিপ্লবের সময় নিহত আইরিশ দম্পতির সন্তান। পরে সে লালিত- পালিত হয় হিন্দু ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর কাছে। গোরা আস্তে আস্তে হিন্দু ধর্মের অন্ধ সমর্থক হয়ে উঠে।সময়ের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এক নারীর ভালোবাসা কিভাবে তাকে অন্ধতা ও সংকীর্ণতা থেকে নির্দিষ্ট ধর্মকে অতিক্রম করে মানবতাবাদী আদর্শিক মহাভারতবর্ষের দিকে পৌঁছে, তারই কাহিনী 'গোরা' উপন্যাস। এ উপন্যাসে ব্যক্তির সাথে সমাজের, সমাজের সাথে ধর্মের এবং ধর্মের সাথে সত্যের বিরোধ ও সমন্বয় চিত্রিত হয়েছে।

প্র. 'শেষের কবিতা' উপন্যাসের পরিচয় দাও।

উ. রবীন্দ্রনাথের কাব্যধর্মী উপন্যাস 'শেষের কবিতা' (১৯২৯)। এটি ১৯২৮ সালে 'প্রবাসী' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ভাষার অসামান্য কবিত্ব, দৃপ্তশক্তি ও পাণ্ডিত্যের দীপ্তি এ উপন্যাসটিকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে যা রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সুকুমার সেন এ উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন, 'বৈষ্ণব সাধনায় পরকীয়াতত্ত্ব রবীন্দ্রনাথের কবিমানসে যেভাবে রূপান্তর লাভ করিয়াছিল শেষের কবিতায় তার পরিচয় পাই'। অমিত ও লাবণ্যের প্রণয়কাহিনী সাহিত্যিক ব্যঞ্জনায় অমর হয়ে উঠেছে এবং বিচিত্রতা দান করেছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অমিত রায় ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়েছি। তার ছেলে বন্ধুর চেয়ে মেয়ে বন্ধু বেশি। এদের মধ্যে কেতকীর সাথে অমিতের প্রেম হয় এবং অমিতের দেয়া আংটিও পরে। ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে অমিত শিলংয়ে বেড়াতে গেলে উপন্যাসের মূল নায়িকা লাবণ্যের সাথে পরিচয় থেকে প্রেম হয়। কিন্তু লাবণ্য বুঝতে পারে অমিত রোমান্টিক জগতের স্বপ্নাতুর ব্যক্তি। তবুও তাদের বিয়ে ঠিক হলে উপস্থিত হয় কেতকী। ভেঙ্গে যায় বিয়ে। কেতকীর সাথে অমিতের বিয়ে উপন্যাসকে ভিন্নতর রূপ দান করেছে। লাবণ্য বিয়ে করে শোভনলালকে। উপন্যাসের কিছু বাক্য আজ প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। যেমন- ফ্যাশনটা হলো মুখোশ, স্টাইলটা হলো মুখশ্রী। 'কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও' কবিতার মাধ্যমে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ উপন্যাসে ভাষাবিদ ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখ আছে।

প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রধান নাটকগুলোর নাম কী?

উ. রবীন্দ্রনাথের মোট নাটক ২৯টি, কাব্যনাট্য ১৯টি। রূপক ও সাংকেতিক নাটক: [৪১তম বিসিএস লিখিত।

'ডাকঘর' (১৯১১): এ নাটকের নায়ক অমল ঘরের মধ্যে বন্দী এক রুগ্ন বালক। তার ধারণা, সে একদিন বাইরে যাবে এবং তার নামে রাজার চিঠি আসবে। বিষয়ী লোকেরা তাকে উপহাস করত। কিন্তু একদিন সত্যি সত্যি রাজা এলেন। চরিত্র: অমল।                   

'কালের যাত্রা' (১৯৩২): এটি শরৎচন্দ্রকে উৎসর্গ করেন।                   

'তাসের দেশ' (১৯৩৩)। রাজপুত্র ও সওদাগর পুত্র এক  অপরিচিত দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন, যে দ্বীপের জীবন শাসিত হয় যান্ত্রিক নিয়মানুবর্তিতায়, যুক্তি ও হৃদয়হীন শাসনতন্ত্রের আনুগত্যে। রাজপুত্র ও সওদাগরপুত্র স্বাধীনভাবে বসবাসের জন্য করলেন বিদ্রোহ, এটাই এ নাটকের মূল বিষয়। এটি রবীন্দ্রনাথ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেন।

'প্রকৃতির প্রতিশোধ' (১৮৮৪), 'রাজা ও রাণী' (১৮৮৯), 'রাজর্ষি' (১৯১০), 'অচলায়তন' (১৯১২), 'রক্তকরবী' (১৯২৬)।

নৃত্যনাট্য: এ নাটকের মূল বৈশিষ্ট্য হলো গীতিনির্ভর নাট্যধর্মী নৃত্য। বিভিন্ন কাহিনী অবলম্বনে নৃত্য নির্মিত হয়।

'চিত্রাঙ্গদা' (১৮৯২): মনিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা ও অর্জুনের পৌরাণিক প্রণয় কাহিনী অবলম্বনে রচিত এ নাটক। এটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত।

'নটীর পূজা' (১৯২৬): রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'কথা ও কাহিনী'র অন্তর্গত পূজারিণী কবিতাটির আখ্যান অবলম্বনে এ নাটকটি রচনা করেন। এ নাটকে প্রথম অভিনয়ের সাথে নাচ ও গানের প্রয়োগ ঘটে।

'চণ্ডালিকা' (১৯৩৩): 'প্রকৃতি' একজন চণ্ডালী কন্যা। সে কিভাবে তার মায়ের সাহায্যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে প্রলোভিত করেছিল, সেই কাহিনীই এর মূল বিষয়। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ যেমন এর প্রধান সুর তেমনি আছে সংরাগের প্রকাশ ও সংযমের সুষমা।

'শ্যামা' (১৯৩৯)।

কাব্যনাট্য: (২৭তম বিসিএস লিখিত)

'প্রকৃতির প্রতিশোধ' (১৮৮৪), 'মায়ার খেলা' (১৮৮৪),    'বিদায় অভিশাপ' (১৮৯৪)।    

গীতিনাট্য:

'বসন্ত' (১৯২৩): এ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন। অনেকেই এ উৎসর্গের বিষয়টি সহজে মেনে নিতে পারেনি। এর প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- 'নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তোমাদের মনে যেন কিছু সন্দেহ রয়েছে। নজরুলকে আমি 'বসন্ত' গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে 'কবি' বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারোনি। আমার বিশ্বাস, তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছো। ....... সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাঁধা, অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝংকার তোলে, ঐকতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি। আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও ঐ সুর বাজতো।'  

 'কালমৃগয়া' (১৮৮২)  

অন্যান্য নাটক: 'শারদোৎসব' (১৯০৮), 'প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০৯), 'মুক্তধারা' (১৯২২)।    

প্রহসন: 

'বৈকুণ্ঠের খাতা' (১৮৯৭): এক আত্মভোলা সরল প্রকৃতির বৃদ্ধকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নানা কৌতুকময় ঘটনা, যা এ প্রহসনের মূল বিষয়। এটি কৌতুক প্রকৃতির প্রহসন।    

'চিরকুমার সভা' (১৯২৬): রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০০-১৯০১ সাল পর্যন্ত 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় 'প্রজাপতির নির্বন্ধ' নামে একটি আখ্যান রচনা করেন। পরবর্তীতে এটি ১৯০৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে 'প্রজাপতির নির্বন্ধ'কে 'চিরকুমার সভা' নামে নাট্যরূপ দেন। একদল যুবকের বিয়ে না করার প্রতিজ্ঞা এবং পরে প্রতিজ্ঞাভঙ্গের কৌতুককর কাহিনী নিয়ে এ প্রহসন রচিত।

'গোড়ায় গলদ' (১৮৯২), 'হাস্যকৌতুক' (১৯০৭), 'শেষ রক্ষা'।

  • গল্পসল্প (কাব্যগ্রন্থ) =  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  • গল্পগুচ্ছ (গল্পগ্রন্থ) = রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
  • গল্পবীথি (গল্প) = প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
  • গল্পাঞ্জলি (গল্প) = প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

প্র. 'বিসর্জন' নাটকের পরিচয় দাও।

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মঞ্চসফল ও জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে অন্যতম 'বিসর্জন' (১৮৯০)। এটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত নাটক। এ নাটকে শুধু আত্মবিসর্জনে সমস্যার সমাধান খোঁজা হয়নি, তার চেয়েও কঠোর ত্যাগের মধ্য দিয়ে বিরোধের অবসান প্রদর্শিত হয়েছে। উদার ধর্মবোধ এবং সংকীর্ণ ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেমন এ নাটকের প্রধান উপকরণ, তেমনি বিশ্বাসের উগ্রতা এবং মানব সম্পর্কের নিবিড়তা এ নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথ নিজে এ নাটকের রঘুপতি ও জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেন। অন্যান্য চরিত্র: অপর্ণা, গুণবতী, গোবিন্দ্যমাণিক্য।

প্র. 'রক্তকরবী' নাটকের পরিচয় দাও।

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাংকেতিক নাটক 'রক্তকরবী' (১৯২৬)। মানুষের প্রবল লোভ কিভাবে জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত করে এবং এর বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কি রূপ ধারণ করে, তারই রূপায়ণ 'রক্তকরবী' নাটক। এ নাটকে ধনের উপর ধানের, শক্তির উপর প্রেমের এবং মৃত্যুর উপর জীবনের জয়গান গাওয়া হয়েছে।

প্র. বাংলা ছোটগল্পের জনক কে?

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রধান ছোটগল্পগুলোর নাম কী?

উ. রবীন্দ্রনাথের মোট ছোটগল্প ১১৯টি।

প্রেম সম্পর্কিত গল্প:

'শেষকথা', 'মধ্যবর্তিনী', 'সমাপ্তি' (নায়িকা: মৃন্ময়ী), 'নষ্টনীড়' (চরিত্র: চারু; এ ছোটগল্পটি উপন্যাসসম), 'একরাত্রি' (নায়িকা: সুরবালা)।

সমাজ সম্পর্কিত গল্প:

'ছুটি' (চরিত্র: ফটিক); 'হৈমন্তী' (চরিত্র: হৈমন্তী, অপু, গৌরীশঙ্কর। যৌতুক প্রথার প্রাধান্য); 'পোস্ট-মাস্টার' (চরিত্র: রতন); 'দেনাপাওনা' (বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্প); 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' (চরিত্র: রাইচরণ); 'কাবুলিওয়ালা' (চরিত্র: রহমত, খুকি। মুসলমান চরিত্র সংযুক্ত); 'শাস্তি' (চরিত্র: চন্দরা); 'রবিবার' (চরিত্র: অভীক, বিভা); 'দুরাশা': 'মাস্টার মশাই'।

অতিপ্রাকৃত গল্প: 'ক্ষুধিত পাষাণ' (চরিত্র: মেহের আলী), 'কঙ্কাল', 'নিশীথে', 'জীবিত ও মৃত' (চরিত্র: কাদম্বিনী)। 

প্র. রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য কী কী?/২৮তম বিসিএস লিখিত 

উ. বাংলা ছোটগল্পের সার্থক রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আনন্দময় বৈচিত্র্যে ভরা ছোটগল্প সৃষ্টি তাকে বিখ্যাত সাহিত্যিক হিসেবে বিশ্বজনীন খ্যাতি ও স্বীকৃতি প্রদান করেছে। বাংলার নির্জন প্রান্তর, নদীর তীর, উন্মুক্ত আকাশ, বালুচর, অবারিত মাঠ, ছায়া-সুনিবিড় গ্রামে সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন, অভাবক্লিষ্ট অথচ শান্ত, সহিষ্ণু গ্রামবাসী ইত্যাদি বিষয় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি 'সোনার তরী' কাব্যের 'বর্ষাযাপন' কবিতায় ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। 

ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা,                                   ছোট ছোট দুঃখ কথা 

                                  নিতান্তই সহজ সরল, 

সহস্র বিস্মৃতি রাশি                                   প্রত্যহ যেতেছে ভাসি 

                                  তারি দু-চারিটি অশ্রুজল। 

নাহি বর্ণনার ছটা,                                   ঘটনার ঘনঘটা 

                                  নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ 

অন্তরে অতৃপ্তি রবে,                                    সাঙ্গ করি মনে হবে 

                                  শেষ হয়েও হইল না শেষ। 

প্র. রবীন্দ্রনাথের প্রধান প্রবন্ধ গ্রন্থগুলোর নাম কী? 

উ. 'কালান্তর' (১৯৩৭): এটি ভারতবর্ষীয় রাজনৈতিক সমস্যা বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলন। 

'পঞ্চভূত' (১৮৯৭): এ প্রবন্ধগুলি 'সাধনা' পত্রিকায় 'পঞ্চভূতের ডায়রি' নামে প্রকাশিত হতো। পত্রিকায় প্রকাশের সময় লেখকের নাম ছাপা হতো 'লেখক ভূতনাথ বাবু'। 'বিবিধ প্রসঙ্গ' (১৮৮৩), 'বিচিত্র প্রবন্ধ' (১৯০৭), 'সাহিত্য' (১৯০৭), 'শিক্ষা' (১৯০৮), 'মানুষের ধর্ম' (১৯৩৩), 'সভ্যতার সংকট' (১৯৪১)। 

প্র. 'সভ্যতার সংকট' সম্পর্কে কী জান? 

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বশেষ গদ্যরচনা 'সভ্যতার সংকট' (১৯৪১)। এ ক্ষুদ্র কিন্তু অসামান্য প্রবন্ধে ইউরোপীয় সভ্যতা ও ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের তীব্র সমালোচনা ও মানবতার প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশিত। 'মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ' উক্তিটি তিনি এ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। 

প্র. রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনী সমূহ কী কী? ৪৪তম বিসিএস লিখিত। 

উ. 'য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র' (১৮৮১): এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত ভ্রমণকাহিনী। এটি চলিত ভাষায় লিখিত। 'য়ুরোপ প্রবাসীর ডায়েরি' (১৮৯১), 'জাভা যাত্রীর পত্র' (১৯২৯), 'জাপান যাত্রী' (১৯১৯), 'রাশিয়ার চিঠি' (১৯৩১), 'পারস্যে' (১৯৩৬)। 

প্র. রবীন্দ্রনাথের ধ্বনিবিজ্ঞানের উপর লেখা গ্রন্থের নাম কী? 

উ. 'শব্দতত্ত্ব' (১৯০৯)। 

প্র. রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থের নাম কী? 

উ. 'বিশ্বপরিচয়' (১৯৩৭)।

প্র. রবীন্দ্রনাথের পত্র সংকলনগুলো কী কী?

উ. 'ছিন্নপত্র' (১৯১২): এতে মোট ১৫১টি পত্র আছে। এর প্রথম ৮টি পত্র শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে এবং ১৪৩টি পত্র ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা।

 'ভানুসিংহের পত্রাবলী': এটি রানু অধিকারীকে লেখেন।                  

'পথে ও পথের প্রান্তে': নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা।

প্র. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলার সংখ্যা কত?

উ. ৭০ বছর বয়সের পর তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। তার অঙ্কিত ছবি ও স্কেচের সংখ্যা প্রায় ২০০০। নিজের আঁকা ছবিগুলোকে তিনি 'শেষ বয়সের প্রিয়া' বলে আখ্যায়িত করেছেন।

  প্র. রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের নাম কী?

উ. 'জীবনস্মৃতি' (১৯১২): এতে রবীন্দ্রনাথের বাল্যকাল থেকে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত কালের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

'চরিত্রপূজা' (১৯০৭), 'ছেলেবেলা' (১৯৪০)।  

প্র. রবীন্দ্রনাথের সনেট জাতীয় রচনা কোনটি?  

উ. বাংলার মাটি বাংলার জল।  

প্র. বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে?  

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে (১৩১২ বঙ্গাব্দ) কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে আয়োজিত একটি সভায় 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটি প্রথম গীত হয়েছিল। ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে সঞ্জীবনী পত্রিকায় গানটি মুদ্রিত হয়। একই বছরে বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে গানটি তাঁর 'গীতবিতান' গ্রন্থের স্বরবিতানের স্বদেশ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি গগন হরকরার বাউল গান 'আমি কোথায় পাব তারে' এর সুরের অনুকরণে গানটির সুরারোপ করেন। ২৫ চরণ বিশিষ্ট এই গানের / কবিতার প্রথম ১০ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বাধীনতার ইশতেহারে ৩ মার্চ, ১৯৭১ সালে ঘোষণা করা হয়। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের বিধানুযায়ী, কণ্ঠে গাইতে গেলে ১০ চরণ আর যন্ত্র সংগীতে বাজাতে গেলে চার চরণ পর্যন্ত বাজাতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট দুইটি (বাংলাদেশ, ভারত) দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা এবং শ্রীলংকার জাতীয় সংগীতের সুরকার। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে বাংলার প্রকৃতির কথা প্রধানভাবে ফুটে উঠেছে।             

প্র. 'রবীন্দ্রনাথ ও ঢাকা' সম্পর্কে কী জান?

উ. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট দুইবার ঢাকায় আসেন। প্রথমবার ১৮৯৮ সালে এবং দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাঙালি উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় আসেন এবং ১০ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে The Meaning of Art শিরোনামে একটি বক্তব্য রাখেন।একই দিনে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্রদের সংবর্ধনায় যোগ দেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে The Rule of the Giant শিরোনামে দ্বিতীয় বক্তৃতা প্রদান করেন। রবীন্দ্রনাথ জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অনুরোধে 'বাসন্তিকা' নামে একটি গীতকবিতা রচনা করেন।

এ কবিতার প্রথম চার পংক্তি নিম্নরূপ:

 

এই কথাটি মনে রেখো

তোমাদের এই হাসি খেলায়

আমি এ গান গেয়েছিলেম

জীর্ণপাতা ঝরার বেলায়।

 

Reference: অগ্রদূত বাংলা